বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৯ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
সরকারী ও বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের দাবি আদায়ের জন্য সরকারী পাওনা আদায় আইন রয়েছে। এ আইনের বিধান মোতাবেক যে মামলা চালু করা হয় তাকে সার্টিফিকেট মামলা বলা হয়। শুধুমাত্র ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের জন্য যে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হয় তাকে রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা বলা হয়। কেউ যদি ভূমির কর যথাসময় পরিশোধ না করেন, তাহলে তহসিলদার তা আদায়ের লক্ষ্যে সরকারী পাওনা আদায় আইনের ৪ ও ৬ ধারা অনুসারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট রেন্ট সার্টিফিকেট মামলার রিকুইজিশন দাখিল করবেন। তিনি সার্টিফিকেট অফিসার হিসেবে প্রাপ্ত মামলাটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে যদি সন্তুষ্ট হন যে পাওনাটি আদায় যোগ্য এবং যথাযথ, তবে তাতে স্বাক্ষর করবেন এবং স্বাক্ষর করা মাত্র সার্টিফিকেট মামলা চালু হলো বলে গণ্য হবে। এরপরই দেনাদারের উপর এ আইনের ৭ ধারা অনুসারে নির্ধারিত ফরমে নোটিস জারী হবে। এ নোটিশের মাধ্যমেই দেনাদার জানতে পারবেন তার নিকট সরকারের বকেয়া পাওনা আছে।
তবে ৭ ধারার নোটিস জারী দেনাদারের উপর কিভাবে জারি হবে সে সম্পর্কে দি পাবলিক ডিমান্ড রিকভারী এ্যাক্ট ১৯১৩ এর দ্বিতীয় তফসিলের ২ থেকে ৯ নং বিধিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। দেনাদারের উপর নোটিশ জারির পর এ আইনের ৮ ধারা অনুসারে দেনাদার সার্টিফিকেট মামলাভুক্ত কোনো সম্পত্তি বিক্রয়/দান বা অন্যকোনো প্রকার হস্তান্তর করতে পারবেন না। সার্টিফিকেট মামলাভূক্ত সম্পত্তি ক্রয় করলে তাতে আইনতঃ ক্রেতার উপর কোনো স্বত্ব সৃষ্টি হবে না। কারণ মামলাভুক্ত সম্পত্তিতে সার্টিফিকেটে উল্লেখিত পাওনা প্রথম দাবী হিসেবে গণ্য হবে এবং অন্য সকলের দাবী স্থগিত থাকবে। ৭ ধারার নোটিস জারী হওয়ার পর মামলাভুক্ত সম্পত্তির উপর ক্রোকের ন্যায় কার্যকর হবে, তাই নিলাম ইস্তেহার জারীর পূর্বে আর কোন ক্রোক আদেশের প্রয়োজন হয় না। আর নোটিশ জারীর পর প্রতারণা করে সম্পত্তি হস্তান্তর করলে, সার্টিফিকেট কার্যকরীকরণে বাঁধা দিলে, নিলাম ক্রেতাকে দখল গ্রহণে বাঁধা দিলে তিনি দন্ডবিধি আইনের ২০৬ ধারার অপরাধে অপরাধী হবেন, যার শাস্তি ২ বছর পর্যন্ত সশ্রম/বিনাশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানা দন্ডের বিধান রয়েছে। দি পাবলিক ডিমান্ড রিকভারী (পি ডি আর) এ্যাক্ট ১৯১৩ এর ৫৮ ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
তবে দেনাদার হিসেবে আপনারও কিছু অধিকার এবং প্রতিকার আছে। এ আইনের ৯ এবং ১০ ধারা মতে আপনার উপর ৭ ধারার নোটিস প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে বা নোটিস না পেয়ে থাকলে সার্টিফিকেট কার্যক্রম বাস্তবায়নের ৩০ দিনের মধ্যে আপনি এই আইনের ৯ ধারা অনুসারে নোটিসে উল্লেখিত সম্পূর্ণ বা আংশিক দায় অস্বীকার করে সার্টিফিকেট অফিসারের নিকট আপত্তি দিতে পারেন। আপত্তি দায়ের না হলে ধরে নেয়া হয় যে পাওনার বিষয়ে দেনাদারের কোন দ্বিমত নেই। আর আপত্তি পাওয়া গেলে সার্টিফিকেট অফিসার ১০ ধারা অনুসারে আপত্তির উপর শুনানী গ্রহণ করবেন, প্রয়োজনে সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন এবং সার্টিফিকেট সংশোধন, বাতিল বা বহাল রেখে সিদ্ধান্ত (রায়) প্রদান করবেন। ১০ ধারা অনুসারে শুনানীর পর সার্টিফিকেট অফিসার যদি মামলা বহাল রাখেন বা ৯ ধারা অনুযায়ী কোনো আপত্তি দায়ের না হয়ে থাকে এবং ৭ ধারার নোটিস জারীর পর ৩০ দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও পাওনা টাকা অনাদায়ী থাকে তবে সার্টিফিকেট অফিসার এ আইনের দ্বিতীয় তফসিলের ৪৬ বিধি বলে একটি প্রকাশ্য নিলাম ইস্তেহার জারী করবেন।
সরকার কিন্তু তার পাওনা আদায়ে মরিয়া। এক টাকা আদায়ের জন্য সরকার কোটি টাকা খরচে আগ্রহী। একটি কেস স্টাডি দিয়েই আলোচনাটি শেষ করতে চাই। ১৯৯০ সালে পাওনা আদায়ের জন্য মামলাটি চুয়াডাঙ্গার সার্টিফিকেট অফিসারের কাছে দায়ের হয়েছিল। দীর্ঘ ২২ বছর পর ৯ জুলাই’ ২০১২ ইং তারিখে পুরো ঋণ আদায় করে এ মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। আসল দেনাদারের মৃত্যুর পর তাঁর ওয়ারিশদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের মাধ্যমে মামলাটির সমাপ্তি ঘটে। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দেনাদারের ওয়ারিশদের মালামাল ক্রোক থেকে শুরু করে বন্ধককৃত স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্রোকের মালামাল আত্মসাৎ করার কারণে জিম্মাদারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে সি.আর মামলাও দায়ের হয়। এরপরও আদায় হয়না পুরো অর্থ। দেনাদারের ওয়ারিশরা অজ্ঞাত ঠিকানায় চলে গেলে ঋণ আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে এ মামলার আদেশ, বাদীর হাজিরা, বিভিন্ন প্রতিবেদন নথির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফুলেফেঁপে নথির ওজন বেড়ে কয়েক কেজি হয়ে যায়। দেনার মূল দাবি ১৫ হাজার ১৩১ টাকা আদায় করতে এক হাজার ৩০০ টাকার কোর্ট ফিসহ কয়েক শ টাকার কাগজও ব্যবহার করতে হয়। চিঠি চালাচালি হয়েছে কয়েক শ। খাতকের ওয়ারিশদের অবস্থান জানতে লোক লাগিয়ে দেয়া হয়। জানা যায়, তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন ভালো। শুধু দেনা পরিশোধের অনিচ্ছা আর উদাসীনতার কারণেই দেনা অপরিশোধিত আছে। অবশেষে মরহুম খাতকের দুই ছেলের গ্রেপ্তার আর বাকি চার হাজার ১৩১ টাকা আদায়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় মামলাটি। মামলার খাতক বা দেনাদার ছিলেন একজন মহিলা। নাম ফয়জুুন্নেছা। তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার বোয়ালিয়া গ্রামে। তিনি পূবালী ব্যাংক, চুয়াডাঙ্গা শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ওই ঋণ শোধ না করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরকারি পাওনা আদায় আইন-১৯১৩, যা সবার কাছে পিডিআর অ্যাক্ট হিসেবে পরিচিত, এর আলোকে ফয়জুন্নেছার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট অফিসারের কাছে একটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে। সার্টিফিকেট অফিসার আইনের ৪৮ ধারা মোতাবেক একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারূপে গণ্য। ৪৯ ধারামতে, এই আদালত দেওয়ানি আদালত হিসেবে কাজ করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ সালে সার্টিফিকেট অফিসার ফয়জুন্নেছার বিরুদ্ধে আইনের ১০(ক) ধারায় নোটিশ জারি করে তাঁকে ৩০ দিনের মধ্যে দেনা পারিশোধের নির্দেশ দেন। দেওয়ানি কার্যবিধির ৬০ ধারা মোতাবেক পিডিআর অ্যাক্টের ১৭ ধারায় দেনাদারের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। ক্রোক করা সম্পত্তি বিক্রি করে দেনার অর্থ আদায় করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্রোক করতে গিয়েই জানা গেল, দেনাদার ফয়জুন্নেছা আর নেই। ১৯৯২ সালের ২৯ নভেম্বর সহকারী নাজির আদালতকে জানান, ক্রোক তামিল করতে গিয়ে জানা যায় তিনি এক বছর আগেই মারা গেছেন। দেনাদারের মৃত্যুতে থেমে যায় ক্রোকের কার্যক্রম।
আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী দেনাদার মারা গেলে তাঁর আইনানুুগ প্রতিনিধির ওপর এর দায় বর্তিত হয়। সার্টিফিকেট অফিসার তাঁদের নোটিশ দিয়ে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা আদালতে হাজির হননি। ফলে তাঁদের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ৭ আগস্ট খাতকদের বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। এ সম্পত্তি বেগমপুর গ্রামের নবিছুদ্দিনের ছেলে বাবুল মোল্লার জিম্মায় রাখা হয়। কিন্তু বাবুল মোল্লা ওই সম্পদের অর্থ আদালতে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে দ-বিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় সিআর ৪৬৫/২০০১ মামলা করা হয়। অবশ্য এক বছর এ মামলা পরিচালিত হওয়ার পর একপর্যায়ে জামিনদার ওই পরিমাণ অর্থ আদালতে জমা দেন। ফলে তাঁর মামলা প্রত্যাহারের জন্য সার্টিফিকেট অফিসার সংশ্লিষ্ট ফৌজদারি আদালতে চিঠি দেন। সার্টিফিকেট অফিসার পাওনা আদায়ের সর্বশেষ পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেন। ফয়জুন্নেছার বন্ধককৃত সম্পত্তি নিলামের আদেশ দেওয়া হলো। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করতে গিয়ে দেখা যায় বিপত্তি। এতে দেখা যায়, দেনাদার সব সম্পত্তিই বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু ভিটের জমিটুকু বাকি রয়েছে। আইন অনুযায়ী কাউকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা যায় না। ফলে স্থাবর সম্পত্তি আর নিলাম করা যায়নি। দিনের পর দিন দেনা পরিশোধের জন্য দেনাদারকে তাগিদই দিতে হয়েছে। অবশেষে ২০০৯ সালের ১৯ এপ্রিল দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন সার্টিফিকেট অফিসার। কিন্তু পুলিশ তা তামিল করেনি। যদিও পিআরবি অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল না হলে তার কারণ উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানোর বিধান রয়েছে।
পরোয়ানা তামিলের প্রতিবেদন না পেয়ে আদালত ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি ধার্য তারিখে পুলিশকে পরোয়ানা তাগিদের পত্র দিয়ে যান। এখন দেনাদারদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় দেনা পরিশোধ, নয়তো সিভিল কারাগারে গমন। কারাবন্দি হওয়ার পর প্রত্যেক বন্দির পেছনে দৈনিক খরচ হয় ২৬ টাকা, যা প্রাথমিক অবস্থায় মামলার বাদীকেই জেল সুপার বরাবর পরিশোধ করতে হয়। এ টাকাও মূল দেনার সঙ্গে যুক্ত করে দেনাদারের কাছ থেকে আদায় করা হয়। দুই ভাই দেনা দিতে রাজি হন। আদালতে বসেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে টাকা দিয়ে দেন। এভাবেই ২২ বছর পর একটি দেনার গল্প শেষ হয়। তবে কোনো দুর্ঘটনার কারণে কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সার্টিফিকেট অফিসার অবশ্যই বিবেচনা করেন। দীর্ঘদিনের কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেন। আদালতের সেই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, তাং-১৬.১১.২০২১